ইংরেজ শাসনামলে বাংলায় বিভিন্ন ধরণের প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। এই আন্দোলনগুলোর প্রেক্ষাপট ও তাৎপর্য আলোচনা করা হলো:
প্রেক্ষাপট:
* রাজনৈতিক কারণ:
* কোম্পানির শাসন: ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের মাধ্যমে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন শুরু হয়। এই শাসনের ফলে বাংলার নবাবদের ক্ষমতা কমে যায় এবং ব্রিটিশদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
* প্রশাসনিক পরিবর্তন: ব্রিটিশরা তাদের নিজেদের সুবিধা মতো প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করে, যা বাংলার ঐতিহ্যবাহী সমাজ ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
* বৈষম্যমূলক নীতি: ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের প্রতি বৈষম্যমূলক নীতি অনুসরণ করত, যার ফলে ভারতীয়দের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়।
* অর্থনৈতিক কারণ:
* অর্থনৈতিক শোষণ: ব্রিটিশরা বাংলার সম্পদ নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করত। তারা বাংলার শিল্প ও বাণিজ্যকে ধ্বংস করে দেয় এবং এখানকার অর্থ ইংল্যান্ডে পাচার করে।
* কৃষি ব্যবস্থার পরিবর্তন: ব্রিটিশদের প্রবর্তিত জমিদারি প্রথা ও অন্যান্য ভূমি রাজস্ব নীতির কারণে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তাদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়।
* শিল্পের ধ্বংস: ব্রিটিশ নীতির কারণে বাংলার তাঁত শিল্পসহ অন্যান্য কুটির শিল্প ধ্বংস হয়ে যায়, যার ফলে অনেক মানুষ বেকার হয়ে পড়ে।
* সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কারণ:
* পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব: ব্রিটিশ শাসনের ফলে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি বাংলায় প্রবেশ করে, যা এখানকার ঐতিহ্যবাহী সমাজ ও সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে।
* ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত: খ্রিস্টান মিশনারিদের মাধ্যমে ধর্ম প্রচার এবং অন্যান্য কারণে মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে।
বিভিন্ন প্রতিরোধ আন্দোলন:
* ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ (১৭৬০-১৮০০): এটি ছিল প্রথম দিকের উল্লেখযোগ্য প্রতিরোধ আন্দোলন। মজনু শাহ, ভবানী পাঠক প্রমুখের নেতৃত্বে এই বিদ্রোহ সংগঠিত হয়।
* ফরাজি আন্দোলন (১৮১৮-১৮৭০): হাজী শরীয়তউল্লাহর নেতৃত্বে এই আন্দোলন শুরু হয়, যা ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কারের পাশাপাশি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধেও ছিল।
* ওয়াহাবী আন্দোলন (১৮২০-১৮৭০): তিতুমীরের নেতৃত্বে এই আন্দোলন ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
* নীল বিদ্রোহ (১৮৫৯): নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কৃষকদের এই বিদ্রোহ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
* সিপাহী বিদ্রোহ (১৮৫৭): এই বিদ্রোহ ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মতো বাংলাতেও প্রভাব ফেলেছিল।
* বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন (১৯০৫-১৯১১): লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন গড়ে ওঠে, যা জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
* গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলন ও আইন অমান্য আন্দোলন (১৯২০-১৯৩০): এই আন্দোলনগুলো বাংলায় ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের গতি বাড়িয়ে দেয়।
তাৎপর্য:
* জাতীয়তাবাদের উন্মেষ: এই আন্দোলনগুলোর মাধ্যমে বাংলায় জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে।
* রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি: এই আন্দোলনগুলো সাধারণ মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করে এবং তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলে।
* স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেরণা: এই আন্দোলনগুলো পরবর্তীকালে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেরণা হিসেবে কাজ করে।
* ব্রিটিশ শাসনের ভিত দুর্বল: এই আন্দোলনগুলোর মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের ভিত দুর্বল হয়ে পড়ে।
ইংরেজ শাসনামলে বাংলায় সংগঠিত প্রতিরোধ আন্দোলনগুলো বাংলার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই আন্দোলনগুলো একদিকে যেমন ব্রিটিশ শাসনের শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে ছিল, তেমনি অন্যদিকে এগুলি বাঙালি জাতির আত্মপরিচয় ও জাতীয়তাবোধ জাগরণেও বিশেষ ভূমিকা রাখে।